স্মৃতির পাতায় ডাকাত
কমল কুমার রায়
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
সলটা ১৯৮৮ সাল হবে-----
তখন আমি ক্লাস ফাইভ - এ পড়াশুনা করি।এখনকার আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা হইতে অনেক পিছিয়ে পড়া সমাজ।
এখনকার ঝকঝকে বড় ন্যাশনাল হাইওয়ে তখন ছিল দুটি গাড়ি পাশ কাটিয়ে কোনক্রমে যাওয়ার পথ। তবে তখনকার পরিবেশে রাস্তার নিকট অর্থাৎ দু-ধরে পি-ডাব্লিউ-ডি দ্বারা সুন্দর সুন্দর গাছ লাগানো হতো এবং পথচারীদের গাছের তলায় বিশ্রাম নেওয়ার অপরপ পরিবেশ ছিল। যেটা বর্তমানে ঝকঝকে ওয়েটিং বা বিশ্রামঘর থাকলেও তখনকার সুন্দরতা এখনো অনুপস্থিত। যাইহোক সুন্দর রাস্তার পরিবেশের পাশে আমাদের একটি বাড়ি ছিল যাহা আম, জাম, পেয়ারা, নারকেল ও কাঁঠাল গাছের বাগান এর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। বাড়ির পশ্চিম দিকে 100 ফুট দূরে একটি পরিবার দক্ষিণে 100 মিটার দূরে একটি, উত্তরের একটু দূরে মাঠ তারপর একটি পরিবার পূর্বে এক টুকরো খালের পাশে একটি পরিবার ও দক্ষিণ- পশ্চিমে একটি পরিবার। তাছাড়া উত্তর-পশ্চিমদিকে 125 ফুট দূরে আমার ছোট কাকার পরিবার থাকতো। সকল পরিবারই গাছপালার দ্বারা আবদ্ধ ছিল। এই সীমানার পূর্বদিকের সেই সুন্দর রাস্তা রাস্তার ওপারে আমার জ্যাঠা মশাই এর ঘর।
ওই সম্মিলিত সীমানার পশ্চিম দিকে সম্পূর্ণ ফাঁকা ধানের ক্ষেত কোন লোকজন বসবাস নেই আছে তবে দু কিলোমিটার দূরে পশ্চিম দিকে, আবার আমাদের প্রিয় নদ জয়দেব পদ্মাবতীর নিকট অজয় নদের প্রবাহ ও তার বাঁধ। বাঁধের পাড় আবার গাছের দ্বারা আবৃত যেখানে দিনের বেলায় যেতেও ভয় করবে।
আমাদের বাড়ী হইতে নিকটবর্তী বাজার বা দোকানের পরিবেশ ছিল দেড় কিলোমিটার দূরে যেখানে কোনো সামগ্রী পাওয়া ও অবসর কাটাতে চায়ের দোকানে লোকজন ভিড় করত। সেই সময় মানুষের আর্থিক কষ্টে এর পরিমাণ ছিল অসীম। আমার বাবা চাকুরিজীবী হওয়ায় তখন কোনমতে কাদার গাঁথুনি দিয়ে ও ইটের সহযোগিতায় এক কামরার বাড়ি তৈরি করেছিলেন। তবে উপরে খরের চাল জানলা কোনমতে কাঠের ফ্রেম দিয়ে লাগানো।ঘরের মধ্যে পরিবেশ ছিল পুবদিকে ১.৫'✘১.৫' কাঠের জানালা, দক্ষিনে দরজা আর ভিতরে একটি ছোট্ট তক্তা। জানলার মাঝের জায়গায় লোহার রড ও পর্যন্ত লাগাতে পারেনি। ভালো করে ঘরটি মজবুত করার সময়ও পায়নি। পাশে একটি মাটির ঘর ছিল। এখানে প্রথমে আমরা থাকতাম।
এমন পরিবেশে বাবা সকাল বেলায় খেয়েদেয়ে অফিসে চলে যেতেন আর সন্ধ্যা সাতটার সময় ফিরে আসতেন। কোন কোন দিন নিকটবর্তী দোকানে বিশ্রাম নিয়ে রাতে বাড়ি আসতেন। রাত্রি হয়ে গেলে চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম ও দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক শোনা যেত। সেই সময় চারিদিকে প্রায় ডাকাত পড়েছে ডাকাত পড়েছে এমন খবর শোনা যেত। তখনকার দিনের সম্ভ্রান্ত পরিবার মানে মোড়ল ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে 300 মিটার দূরে বড় মোড়ল ও দুই কিলোমিটার দূরে ছোট মোড়লের পরিবার ছিল। আর্থিক দিক থেকে তারা উন্নত ছিল। একদিন হঠাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি বড় মোড়লের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। আমরা সবাই সেখানে গেলাম দেখলাম শুনলাম সব ডাকাতি করে নিয়ে গেছে আবার বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে গেছে। সোনার গয়না অর্থ লুট করে নিয়েছে। আমরা সর্বদা রাত হলে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতাম। রাতে ঘরের দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে থাকলেও প্রায় ডাকাতের দলের পায়ের শব্দ শুনতে পেতাম। যেটার আওয়াজ আজও আমার কানে বেজে ওঠে ধ-প--ধ-প,ধ-প--ধ-প। এমন শব্দ শুনতে শুনতে হঠাৎই আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়লো। ঘরের মধ্যে সেই ছোট্ট তক্তায় আমার বাবা শুয়ে আছে আর আমি ও আমার মাতা পাটি/তালাই পেতে শুয়ে আছি।বাবার অনেক কষ্টের অর্থে গলার হার ও কানের দুল মাকে তৈরি করে দিয়েছিল। আমার মা ঐ-দিন ওই কানের দুল দুটি পড়ে ঘুমিয়ে ছিল। রাত গভীর থেকে গভীরতর হল। চারিদিক নিস্তব্ধ কোন কিছুর শব্দ নেই। প্রতিবেশীরাও নিঝুমে ঘুমাচ্ছে। দূরের শিয়ালের ডাক করে চলেছে। উত্তম পরিবেশ। এমন সময় আমরাও ঘরে ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ, হঠাৎ দেখি দরজায় কড়া ও শিকল নাড়ার আওয়াজ। আমি ভয়ে সিটিয়ে গেলাম বাবা-মা ও সবাই সিটিয়ে গেল। দরজা খোল। দরজা খোল বলছি। এমন সময় একজন সেই জানলার পাটাদ্বয়কে জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল। আর সরু দন্ডের অগ্রভাগে ত্রিফলা লাগানো লোহার দন্ড(বল্লম) আমার মায়ের গলায় লাগিয়ে দিল। এবার দরজা খোল না হলে চালিয়ে দেব। বাবা তাড়াতাড়ি তাদের কথামতো বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিল। ডাকাতের দল সব ঘরে ঢুকে পড়ল।টর্চের আলো আমাদের ঘরের ভেতরে মারতে লাগলো। বলল কি কি আছে সব বার কর।সব দিয়ে দে।ট্রাংকের চাবি দে।বলে আমাদের সবকিছু নিয়ে চলে গেল। আমরা হতবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। এমনকি আর্থিক পরিবেশের কথা বিবেচনা করলে বাবার সকল ভাল জামা কাপড় তারা নিয়ে চলে গেল। তাদের মুখে সব কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা, চোখদুটি শুধু একটু দেখার মত। বাকি সব ঢাকা। আমার কাকিমা তখন তাঁতের ব্যাগ বুনতো ও আমাকে একটা দিয়েছিল আমার বিদ্যালয়ে বইপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। ডাকাতের দল তখন সেই উপহারের ব্যাগটাও ডাকাতি করে নিয়েছে নিয়ে গেল। যেটার আফসোস আজও ভুলতে পারিনি। আজ আমার কাছে অগুনতি দামী দামী ব্যাগ আছে কিন্তু তখনকার দিনের স্মৃতির সেই ব্যাগ আজও আমার কাঁদিয়ে ছাড়ে। তবে ডাকাতি করার সময় তারা কোন রকম অত্যাচার করেনি। কারণ বাবা চাবিও সোনাদানা যা ছিল সবই দিয়ে দিয়েছিল। ডাকাতি করার পর তারা বাইরে থেকে দরজায় শিকল দিয়ে যায় এবং বলে চিৎকার না করতে। সেই রাতে আমার কাকা ডাকাতির ঘটনা বুঝতে পারে এবং তারা অর্থ সোনা দানা নিয়ে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরে মাঠে চলে যায়। কারন তাদের সঙ্গে তো তারা পেরে উঠবে না। ডাকাতরা চলে যাওয়ার পর কাকারা আমাদের দরজা খুলে দিয়ে উদ্ধার করে। ডাকাতির ফলে বাবার অফিসে যাওয়ার জামাকাপড় পর্যন্ত ছিল না। তারফলে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী কয় করে এনে বাবাকে অফিসে যেতে হয়। আর আমার বিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যাগটা নিয়ে যাওয়ায় দুঃখে আমাকে সাদা রঙের কাপড়ের পলিথিনের প্যাকেটে বইপত্র নিয়ে যেতে হয়। এই দুঃখের দৃশ্য আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার মনের স্মৃতিতে।
যাইহোক এমন ডাকাতি যেন কোনদিনও কারো ক্ষেত্রে না ঘটে। আজ আমি পলিথিনের প্যাকেটে বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করেও বাবা মায়ের আশীর্বাদে শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে বিরাট পাওনা।