শ্যাম বর্ণের সেই মেয়েটি _ সাদিয়া পারভীন

0



শ্যাম বর্ণের সেই মেয়েটি

★★★★★★★★★

সাদিয়া পারভীন

বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সবাই যে যেমন পারে খেলছে।এক মাঠে কত খেলাযে একই সময়ে চলছে।দাড়িয়াবান্ধা, ফুলটোকা,গোল্লাছুট, কুতকুত খেলা,ফুটবল, আরো কত কি।ওরা যেনো টিফিনের সময় টাকে বৃথা যেতে দিবেনা কিছুতেই। কিন্ত সবার মাঝে একজন কে বড্ড বেমানান লাগছিল। সবাই খেলছে আর একটি মেয়ে - চুলগুলো ভীষণ এলোমেলো, একহারা গড়ন,শ্যামবর্ণ মেয়েটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে।একটু কাছে যেতেই দেখতে পেলাম,মেয়েটি ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। নাম শিলা।ওর শারীরিক বিকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষিক বিকাশ পিছিয়ে পড়েছে। তবে ওকে আমরা অটিস্টিক এর তালিকায়ও রাখিনা।ওর মধ্যে অতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ কখনো চোখে পড়েনি।

শিলা সবসময় শ্রেণিতে একদম পিছনের বেঞ্চে বসত।চেষ্টা করে দুএকবার সামনের বেঞ্চে বসাতে পেরেছি।তবে তার পিছনটাই পছন্দ। সবসময় চুপচাপ থাকা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। পড়ালেখায় কেমন ছিল যদি জিজ্ঞেস করেন,তাহলে বলতে হবে -ওর ধারণা হয়তো ছিল বিদ্যালয় শুধু আসাযাওয়ার জন্য।এটা বলছি কারন ও কখনো পড়া পারলেও বলতনা আবার না পারলেতো নয়ই।

অথচ অবাক হবেন শুনে যে,এই মেয়েটি তার বাড়ির মধ্যমনি ছিল।বাড়ির সব কাজ সে হাসিমুখে করতো। সংসারে অভাব লেগে না থাকলেও অতটা স্বচ্ছলতাও ছিলনা। গা খাটালে ভাত আছে নইলে নাই।এমনটাই অবস্থা ছিল।শিলা গ্রামের কৃষকের মেয়ে তাই তাকে সব কাজই জানতে হবে।বাসন মাজা,কাপড় ধোয়া,ঘর পরিষ্কার এগুলো ছাড়াও গরু,ছাগল মাঠে চড়াতো সে।বিদ্যালয়ের শান্ত,চুপচাপ মেয়েটি জীবনের প্রয়োজনে বাড়িতে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রে রূপান্তরিত হয়।

একদিনের ঘটনা। টিফিনে বারান্দায় বসে আছি।শিলা ওর এক সহপাঠীর সাথে পানি খেতে যাচ্ছিল।আমাকে দেখে দুজনেই সালাম দিল। আমি উত্তর দিয়ে ওদের থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

আমিঃশিলা,কেমন আছো তুমি?

শিলাঃভালো আছি ম্যডাম।আপনি কেমন আছেন?

আমিঃভালো আছি।আজকে তো তোমাকে খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে।

শিলাঃ যার পর নাই লজ্জা পেয়ে বল্ল,আজকে একটু সাজছি।আমার ভাইকে দেখতে আসবি তো।

আমিঃতুমি সবসময় স্কুলে এভাবে চুল আচড়ে সুন্দর পরিপাটি হয়ে আসবে।কেমন?

শিলাঃআচ্ছা।ম্যাডাম।

এরপর আর শিলার সাথে দেখা হয়নি আমার।২০২০ সালের ১৭ মার্চ বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলো। একদিন শুনি ৫ম শ্রেণির শিলা খাতুন খুব অসুস্থ। ওর রক্ত লাগবে। কোনো ডাক্তার নাকি ওর রোগ ধরতে পারছেনা।খোঁজ নিয়ে যা জানলাম তাতে আমি যার পরনাই অবাক হয়েছি।ওর যে একটা অসুখ হয়েছে এ নিয়ে ও-ই অশিক্ষিত পরিবার টির কোনো চিন্তা নাই।ও উপর্যুপরি বমি করছে যখন, তখন ওকে খাওয়ানো হয়েছে নুন পড়া,তেল পড়া।অথচ ধীরে ধীরে ও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল কেউ ঘূনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।গায়ে জ্বর থাকতো তাই অনেকে করোনা বলেও চালিয়ে দিতে চেয়েছিল।পাখপাখালি র কিচিরমিচির ভরা গ্রামটিতে একদিন সকালে, শ্যামবর্ণ, একহারা গড়নের আলুথালু বেশের সেই মেয়েটি সবাইকে মুক্তি দিয়ে চিরবিদায় নিল।

আমি শুনতে পেলাম সেই অকাল মৃত্যু খবর।শুনতে পেলাম তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার নিষ্ঠুর গল্প।বুঝলাম শিক্ষাদীক্ষা হীন মানুষ, মানুষ নয়।অসুস্থ হবার পরেও তাকে সংসারের অনেক কাজ করতে হয়েছে।কি নির্মম বাস্তবতা। যে কাজ সন্তানের দিকে ফিরে তাকাতে দেয়না,সে কাজের কি মূল্য? সবই তো আছে।ঘরের বাইরে উঠোন আছে,গোয়ালে গরুগুলো ঠিক তেমনই আছে,সরিষা মাঠ এখনো হলুদ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে,মগডালে কোকিলের উদাস করা কুহুতান আছে,কর্দমাক্ত সেই পথ আছে,সারা বাড়ি জুড়ে ওর স্মৃতির সুবাসে ভরপুর। শুধু শিলা নেই।শিলাকে ওরা বাঁচতে দেয়নি।ওরা না, ওদের মূর্খতার কাছে পরাজিত হয়েছে শিলার নিষ্পাপ জীবন। পরপারে ভালো থাকুক এই সাধাসিধে,নিষ্পাপ মেয়েটি।

গ্রাম গুলোতে এমনই দুর্দশা। মানুষ অশুভ এক প্রতিযোগিতার প্রতিযোগি যেনো। কার উপর কে উঠবে,কার কয় মন ধান উঠলো ঘরে,কার কয়টা ছাগল, গরু।স্বাস্থ্য সচেতনতা একেবারে শূন্য কোঠায়।এই অশুভ প্রতিযোগিতার নির্মম শিকার হয় নিষ্পাপ শিশুগুলো।এই ২০২০- ২১ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশে শিলার মতো এমন অকাল মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়।সঠিক সময় চিকিৎসা পেলে হয়তো বেঁচে যেতো একটি ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ। প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের ভিতরে যেমন অন্ধকারে ঢাকা থাকে তেমনি এই আধুনিক যুগেও কিছু মানুষ বাতির নিচের অন্ধকারের মতই কুসংস্কার, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্রে,কবিরাজ বাড়িতে প্রচন্ড বিশ্বাসী। এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।কারণ বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ।বিজ্ঞান গবেষণা, প্রমাণে বিশ্বাস করে।নিছক ধারনা,হাওয়ার উপর বিশ্বাস কোনো ভালো ফলাফল আনতে পারেনা।দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমার পরিচিত অনেক শিক্ষিত মানুষও প্রচণ্ড ভাবে কুসংস্কারে বিশ্বাসী। যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়।

পরিশেষে আমার এই লেখা কারো ব্যক্তি অনুভুতিতে

আঘাত করে থাকলে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

সবাই ভালো থাকবেন। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলবেন।

ধন্যবাদ।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)